আজকের গল্প: হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে
জনশূন্য এই কলেজ ক্যাম্পাসের ধারের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে সুবর্ণার কলেজের প্রথম দিন থেকেই ভীষন ভালো লাগতো। আজ প্রায় বছর আটেক পড়েও তাঁর এই ভালোলাগার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিশেষত এই বসন্ত ঋতুতে তাঁর কাছে এই রাস্তাটা যেন এক অনন্য আকর্ষণ, বহুদিন পড়ে হাঁটতে এসে,এই চেনা রাস্তা যে তাঁর কাছে একইরকমভাবে আকর্ষণীয় হয়ে থাকবে,তা তাঁর কাছেও কিছুটা বিস্ময়েরই।কলেজ জীবনের স্মৃতিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো তাঁর আশেপাশে। সুবর্ণা হাঁটতে থাকলো ফুটপাত ধরে, হাঁটতে হাঁটতে তাঁর চোখে পড়লো সুজনদার চায়ের গুমটি, এখনও সেই বাঙালিয়ানা বজায় রেখে সুজনদা ধুতি আর ফতুয়া পড়েই চা বিক্রি করে চলেছে, এই মহামারীর কবলে পড়ে দোকানে ক্রেতার সংখ্যা মনে হচ্ছে আগের চেয়ে অনেকটাই কমে গেছে। এদিকে বিকেলটাও হয়েই গেছে, তবে একটু চা খাওয়া যাক, এই ভেবেই সুবর্ণা গিয়ে দাঁড়ালো সুজনদার চায়ের গুমটির ঠিক পাশেই। দোকানে উপস্থিত একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা এবং এক মাঝ বয়সী অফিস ফেরত যাত্রীর হাতে এক একটি চা-ভর্তি মাটির ভাঁড় ধরিয়ে দিয়ে সুজনদা,সুবর্ণাকে জিজ্ঞাসা করলো, "লিকার,দুধ নাকি স্পেশাল মশলা চা?"সুবর্ণা মৃদু হেসে জবাব দিলো, "মশলা চা একটা।" সুজনদার পক্ষে সুবর্ণাকে মনে রাখা ঠিক কতখানি সম্ভব সেই দ্বিচারিতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সুবর্ণা বিপরীত ফুটে দাঁড়িয়ে থাকা সুপ্রাচীন অট্টালিকাটাকে মনযোগ সহকারে দেখতে থাকলো। একসময় কতবারই যে রঙের তুলিতে ক্যানভাসে তুলে ধরেছে সে এই অট্টালিকাকে।সেইসব যেন অন্য এক যুগের কোলে দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়া এক একটা ইতিহাস। "দিদিভাই!" ডাকটা শুনেই সুবর্ণা বুঝতে পারলো তাঁর জন্য চা তৈরি, তখনই সে সঙ্গে সঙ্গে সুজনদার হাত থেকে চায়ের ভাঁড়টা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। তারপর চা খাওয়া শেষ করে, সুজনদার চায়ের দাম মিটিয়ে সুবর্ণা স্থির করলো এইবার বাড়ি ফেরা যাক, আগামীকাল তাঁর অত্যন্ত জরুরি একটা কাজও আছে সকাল বেলাতেই সেই উদ্দেশ্যে রওনাও দিতে হবে।এই ভাবনা নিয়েই সুবর্ণা হাঁটতে শুরু করলো বাস স্ট্যান্ডের দিকে। হঠাৎই সুবর্ণার পায়ের গতি কিছুটা স্তিমিত হয়ে গেলো, তাঁর সামনে এসে পড়েছেন একজন প্রতিবন্ধী মহিলা, হাতে তাঁর একগোছা গোলাপ এবং অন্য হাতে শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে ধরে আছেন একটি ক্র্যাচ,সুবর্ণার দেখে মনে হলো মহিলার বয়স বছর চল্লিশ হবে,গায়ে জড়ানো শাড়িটায় বেশ ময়লা জমে আছে। "আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে বোন, অন্যদিন একটা গোলাপ পনেরো টাকায় দি, আজ এক পিস দশ টাকা আর দুটো নিলে আঠারো টাকা। ক'টা দেবো বোন?" সুবর্ণা এক মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে বললো, "এই গোছায় যতগুলো গোলাপ আছে সবকটাই আমি নেবো, পনেরো টাকা পিস হিসেবেই নেবো। কতগুলো গোলাপ আছে এখানে?" বিক্রেতা মহিলা বেশ অবাকই হলেন তারপরে হাসিমুখে বললেন, "এখানে কুড়ি পিস গোলাপ আছে ,তবে তোর বর কিন্তু খুব ভাগ্যবান যে তোর মতো একজন মেয়েকে পেয়েছে, এই নে ধর!" সুবর্ণা গোলাপগুলো হাতে ধরে নিয়ে আগে গোলাপের দাম মিটিয়ে দিলো, তারপর গোলাপ বিক্রেতার প্রত্যুত্তরে বললো, "ভালোবাসার মানুষটাকে একবারই নিজের নিজের মুখে নিজের অনুভূতি জানিয়েছিলাম, সে আমাকে খুব ভালোভাবে প্রত্যাখ্যান করে গিয়েছিল, এই গোলাপগুলো আমি তোমাকে উপহার দেবো বলেই কিনলাম,এই নাও এগুলো তোমার,তুমি অন্তত ফিরিয়ে দিও না এই বোনটিকে,হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে!" বিক্রেতা মহিলার হাতে ফুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে সুবর্ণা হেঁটে চললো বাস স্ট্যান্ডের দিকে।মহিলা কিছু বলতে পারলো না শুধু হাতে ফুলগুলো ধরে সেদিকে চেয়ে রইলো, দৃঢ়ভাবে হাঁটতে থাকা সুবর্ণার চোখের কোনে তখন মুক্তবিন্দুর মতো কোয়েক ফোঁটা জল বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরে চকচক করে উঠলো।।
©মাম্পি মল্লিক
আমার লেখা আরো কিছু বাংলা কবিতা ও লেখা যেগুলো আপনার ভালো লাগতে পারে:
0 মন্তব্যসমূহ