বাংলা গল্প: সংশোধন (পর্ব-৩)
এই ঘটনার পরে প্রায় পাঁচ বছর কেটে যায়, সুরজিৎ স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, নিত্য জীবনে ব্যস্ত কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সে এখনো অবিবাহিত। অর্থ , সম্মান, পরিচিতি সবই এখন তাঁর জীবনের সহযোগী।অন্যদিকে দীঘি গ্রাজুয়েশন শেষ করে আগামী ছয় মাসের মধ্যেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক সাধারণ কর্মচারী হিসেবে যোগদান করেছিলো। সুরজিৎ নিজের প্রফেশনাল জীবনকে এতটাই গুরুত্ব দিতে থাকে যে তার পক্ষে বাকি যেকোনো বিষয়কেই অনর্থক সময় ব্যয়ের সমান বলে মনে হয়। চাকরী জীবন চলাকালীনই দীঘির মা এবং মামার বাড়ির আত্মীয়রা সিদ্ধান্ত নেয় দীঘিকে এইবার বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত, 'কন্যাসম্প্রদান' শব্দটি কিছু মানুষের কাছে অপমানসূচক হলেও, অধিকাংশ বাড়িতেই বিশেষত যুবতী কন্যা সন্তান-এর বাড়ির লোকেদের ক্ষেত্রে এই শব্দটা যথেষ্ট দুশ্চিন্তার। তাই এই দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে ফেলাটাই তাঁরা সঠিক বলে মনে করে, অন্যদিকে দীঘি সুরজিৎ-দা ব্যতীত কোনো পুরুষকে কোনোদিনই কাউকে নিজের মনে সেই জায়গা দিতে নারাজ, কিন্তু সে সব কথা তো নিজের মন ব্যতীত আর কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। এমনভাবেই দীঘির জীবন কাটতে থাকে, এই সময়ে এক অনাহুতের মতো এসে উপস্থিত হয় আরও এক বিপদ, দীঘির চাকরি চলে যায়। কোম্পানির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে যার ফলে মালিক পক্ষের এই সিদ্ধান্ত, বেশ কিছু কর্মচারীর চাকরি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে দীঘিও অন্যতম। দীঘির কঠিন জীবন যেন কঠিনতর হয়ে উঠেছে।এমন সময়ে সুরজিৎও কলেজের কয়েক দিনের ছুটিতে বাড়ি ফিরেছিলো, বাড়ি ফেরার ঠিক পরের দিন,দুপুরবেলায় খাওয়া দাওয়া করে সে তাঁর ইউনিভার্সিটির সিনিয়ারের বাড়ির উদ্যেশ্যে রওনা দেয়। পাড়ার মোড় থেকে সে একটি ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে, ঘন্টা দুইয়ের রাস্তা । রাস্তায় সুরজিৎ-এর ট্যাক্সিটিকে পিছন দিক থেকে ধাক্কা দেয় একটি লরি, ট্যাক্সি চালক ও সুরজিৎ দু'জনই গভীরভাবে আহত হয়। স্থানীয় ট্রাফিক পুলিশ এর সহায়তায় তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, কিছুক্ষনের মধ্যেই সেখানে সুরজিৎ-এর বাড়ির লোকজন পৌঁছে যায়। পরের দিন খবর পাওয়া যায় সুরজিৎ-এর একটি পা বাদ দিতে হয়েছে অপারেশনে এবং ট্যাক্সি চালক মারা গেছেন। এক সপ্তাহের শেষে সুরজিৎ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরে,সেই দিনই দুপুরবেলায় দীঘি সেই ঘটনার পাঁচ বছর পরে প্রথম বার দেখা করতে আসে সুরজিৎ-এর সঙ্গে । সুরজিৎ-এর ঘরে ঢুকে আজ দীঘি ঠিক দরজার কাছে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে, তাঁর মুখে যেন একরাশ কালো মেঘ জমেছে।সুরজিৎ পায়ের শব্দ পেতেই দরজার দিকে চেয়ে দেখলো দীঘি দাঁড়িয়ে আছে।
ক্লান্ত গলায় সুরজিৎ বললো, "ভিতরে এসে বোস!" দীঘি বাধ্য মেয়ের মতো ঠিক তাই করলো। দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর সুরজিৎ বললো, "কেমন আছিস, কতো বড়ো হয়ে গেছিস, গতবার মা বলছিলো তোর কথা তুই নাকি ভালো একটা কাজ করছিস শুনলাম, অফিসটা কোথায় তোর?" দীঘির কালো মেঘ জমা মুখ যেন আকাশ ভাঙা বৃষ্টি হয়ে নামলো সুরজিৎ-এর ঘরে তাঁরই চোখের সামনে। "কাঁদিস না ! কাঁদছিস কেন তুই?....দীঘিরে তোর সহজ সরল ভালোবাসার টান যেন এই পাঁচটা বছরে আমি আরও বেশি করে বুঝতে পেরেছি, তাই আজও আমি দীঘির পরিপূরক খুঁজে পাইনি, এই পাঁচটা বছরে আমি, তোর মধ্যে আমার জন্য জমিয়ে রাখা অনুভূতিদের আরও বেশি করে অনুভব করতে পেরেছি।এই অভাগা সুরজিৎ-দা-কে ক্ষমা করে দিস রে দীঘি, আমি তোর ভালোবাসার সম্মান করতে পারিনি!" বললো সুরজিৎ, তাঁর চোখেও জল। দীঘি নিজের চোখ মুছে কান্নাভেজা গলায় বললো, "সাবধানে থেকো!" এই বলে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর সুরজিৎ-এর অক্ষত পায়ে দু'হাত ছুঁয়ে নিজের মাথায় ঠেকিয়ে ঘর থেকে বেরোতে যাবে, এমন সময় সুরজিৎ বললো, "আর একটু বসবিনা আজকে?"
দীঘি থেমে গেলো তারপর আবারও সুরজিৎ-এর বিছানার কাছে এসে বললো, "আজকে রাত আটটার ট্রেনে আমরা হাওড়া যাবো, সেখানে মামার সঙ্গে দিল্লি চলে যাবো, আগামী মাস থেকে ওখানেই একটা ফার্মিং কোম্পানি শুরু হচ্ছে, মামার রেকমেন্ডেশনে ওখানেই আমার কাজ ঠিক হয়েছে, তাই কলকাতা ছাড়তে হচ্ছে।......" নিস্তব্ধতা তখন চারিদিক জুড়ে একটা গুমোট আবহাওয়া তৈরি করেছে। দীঘির চোখ ছলছল করছে,সুরজিৎ বিষন্ন অথচ হাসি মুখে বললো, "বেশ! সাবধানে যাস!"
ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে চারটে, সুরজিৎ জানালা দিয়ে দেখতে পেলো পশ্চিমে সূর্য তখন অস্তগামী কমলা আলো সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে.....একটা বিষণ্ন বিকেল, সুরজিৎ চোখ বুজলো।
সমাপ্ত
©মাম্পি মল্লিক
0 মন্তব্যসমূহ