বাংলা গল্প: সংশোধন (পর্ব-২):
দীঘি অনাহুতর মত গিয়ে সুরজিৎ- দের বাড়িতে উপস্থিত হয়। সুরজিৎ-এর মা একতলার বারান্দায় তখন দাঁড়িয়ে কারোর অপেক্ষায়, ঠিক সেই সময়ই দীঘি গিয়ে উপস্থিত। সুরজিৎ-এর মা দীঘিকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করলো," দীঘি , মা , পাড়ায় তোর কাকুকে দেখলি?" দীঘি তাৎক্ষণিক "না" বলেই দু'তলায় সুরজিৎ-এর ঘরের উদ্দেশ্যে দৌড় দিলো। সুরজিৎ সেই সময় একটা সিগারেট হাতে কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাগজের খোঁজ করছিলো তাঁর পড়ার টেবিলে, দীঘির গলার শব্দে সে কিছুটা চমকে যায়।সিগারেটে আরও একটা টান দিয়ে সে দীঘিকে বলে, "কী রে তুই এখানে? মণ্ডপে যাসনি? বরণ দেখতে?" দীঘি উত্তর দেয় " না"। আসলে দীঘি নিজেও জানে না যে সে এমন উদ্ভ্রান্তের মতো সুরজিৎ-এর কাছে ছুটে এলো , তাঁর মনে এমন অশান্ত আবহাওয়া কেন? এভাবে হুট করে কারোর ঘরে ঢুকে পরাটা যে অশোভনীয় সেটা জানা সত্ত্বেও সে এমন কাজটি করার আগে কেনই বা দু'বার ভাবলো না। সুরজিৎ আবারও জিজ্ঞেস করলো," কী রে দীঘি? চুপ করে আছিস কেন?" এবার দীঘির ঘোর কাটলো , সে কী বলবে বুঝতে না পেরে সুরজিৎ-এর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো, তারপর সে বললো, " না! মানে আমি আমার নোটসের খাতাটা বোধ হয় সেদিন তোমার বাড়িতেই ফেলে গিয়েছিলাম তাই খুঁজতে এলাম!" সুরজিৎ বললো "তোর খাতা! আমার তো চোখে পড়েনি, দেখ খুঁজে, থাকলে এখানেই কোথাও থাকবে।" তারপর সুরজিৎ একটি বই নিয়ে গিয়ে তাঁর খাটের উপরে বসে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ খাতা খোঁজার অভিনয় করে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে দীঘি পড়ার টেবিলের পাশে থাকা চেয়ারে বসে পড়ে। " কী রে খাতাটা পেলি?" প্রশ্ন করে সুরজিৎ, প্রত্যুত্তরে দীঘি জানায়, "না! খাতা তো পেলাম না তবে কয়েকটা প্রশ্ন পেয়েছি করতে পারি?উত্তর দেবে?" দীঘির চোখ-মুখ যেন সত্যিই সেই সময় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত একটা দীঘিতে পরিণত হয়েছে, যার ক্লান্তি পুরো পরিবেশ জুড়ে একটা বিষাদের ছায়া ফেলেছে, সেই ছায়া যেন সুরজিৎ-এর চোখে স্পষ্ট।এর আগে কোনোদিন দীঘির এমন ক্লান্তিমাখা,বিষাদগ্রস্ত মুখ সুরজিৎ দেখেনি। কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে পারে যে দীঘি, তাঁর এমন অবস্থা দেখে সুরজিৎও বেশ অবাক হয়। সুরজিৎ বলে, "অবশ্যই বল না! তোর কোনো বিষয়ে জানতে চাওয়ার তাগিদটাই সবচেয়ে ভালো একটা গুণ, অন্যান্য স্টুডেন্টদেরও আমি এটাই বলি সবসময়, বিষয়ের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করাটা ঠিক কতখানি জরুরি।" "আমাকেও নিয়ে যাবে সুরজিৎ-দা, তোমার সাথে? রাখবে তোমার কাছে?" জিজ্ঞেস করলো দীঘি, কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থেকে সুরজিৎ বললো, " তুই আমার সাথে যাবি? মানে দুর্গাপুরে যেতে চাইছিস না কী তুই? তোর প্রশ্নের কোনো অর্থ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কেনই বা এমন অনর্থক প্রশ্ন করছিস, এখানে কাকিমা, তোর পড়ানো , লেখা-পড়া এসব ছেড়ে তুই আমার সঙ্গে যাবি?" কথাগুলো বলতে বলতে হেসে ফেলে সুরজিৎ , তারপরে সে বলে, "বেশ আগামী ক'মাস পরে যখন মা যাবে আমি না হয় বলবো তোকে আর কাকিমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে কেমন?"সুরজিৎ-এর এই উত্তর শুনে দীঘির চোখ-মুখের ক্লান্তির ছাপ নিমেষেই সরে যায় তাঁর মুখে নেমে আসে ঘন কালো মেঘ, যা থেকে অকাল শ্রাবণ বিষাদের বর্ষণ ঘটাতে চায়।সুরজিৎ এইবার দীঘির মুখ দেখে কিছুটা অবাক হয়, দীঘি-র এইরূপ হঠাৎ করা প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর শোনার পরে দীঘির এমন বাকরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া সুরজিৎ-কে উদ্বিগ্ন করে তোলে।সুরজিৎ-এর মনে হয় দীঘি কোনো বিশেষ কারণে হয়তো বা ভীষনভাবে চিন্তিত,সেই জন্য সে এমন উতলা হয়ে এইরকম সব প্রশ্ন করে ফেলছে। দীঘি একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো, "জীবনে প্রত্যাশা কারোর থেকেই কোনোদিন করিনি, আজও করি না, তোমার সান্নিধ্যে আমি নিজেকে পূর্ণ বোধ করি, তাই তোমার সন্নিধ্যটুকুই আমার কাম্য সুরজিৎ দা। আমি আজীবন তোমারই সান্নিধ্যে থাকতে চাই। তুমিই তো আমার কাছে একজন গুরু, শিক্ষক, প্রকৃত অর্থে বন্ধু এবং আদর্শ একজন অভিভাবক। জীবনের প্রতিটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই আমি তোমার দ্বারস্থ হই । তুমিই যদি আমার জীবন এতটা দূরে চলে যাও আমি কীভাবে থাকি বলো? আমি আমার বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কোনোটাই তো তোমাকে বাদ দিয়ে ভাবতে পারি না। আমার জীবনে সমার্থক শব্দটা যে তুমি হয়ে দাড়িয়েছো।" বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল দীঘি, সুরজিৎ-এর তখন কেবল একটাই কথা মনে হতে থাকলো যেন দীঘি একটা আয়না তুলে ধরেছে তাঁর সামনে, তাতে একটা অন্যরকম, একদম অনাবিষ্কৃত, সুপ্ত একটি চেহারা ফুটে উঠেছে তাঁর, সেই আয়নার সম্মুখীন হওয়াটা যেন তাঁর কাছে একটা জীবনের অন্যতম কঠিন পরীক্ষার মতো মনে হল, যাতে উত্তীর্ন হওয়া তাঁর মতো বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের কাছেও ভীষণই কষ্টদায়ক।....
(গল্পের পরবর্তী অংশ শীঘ্রই প্রকাশিত হবে)
©মাম্পি মল্লিক
আমার লেখা আরো কিছু বাংলা কবিতা ও লেখা যেগুলো আপনার ভালো লাগতে পারে:
0 মন্তব্যসমূহ