"এই মোহর আমার হাতটা চেপে ধর....না হলে যে পড়ে যাবো!"- এই বলে শ্রেয়া হেসে উঠলো।মোহর তৎক্ষণাৎ শ্রেয়ার হাতটা চেপে ধরে বললো,"এই জন্যই বলতাম হাইটটা গ্রো করার চেষ্টা কর! তাহলে বাসের হ্যান্ডেলটা অন্তত ধরতে পারতিস।" তারপরেই চলে এলো তাঁদের গন্তব্য স্টপেজ ডানলপ।আসলে ডানলপের সোনালী সিনেমা হলের কাছেই ওরা দুজন অনার্সের টিউশন পড়তে যেতো। কলেজ জীবনের শুরু থেকেই ওদের দুজনের বন্ধুত্ব, তারপর থেকে মোটামুটি সব কিছুতেই ওরা একসঙ্গে। থার্ড ইয়ারের টেস্ট হয়ে গেছে অনেকদিনই , এইবার ফাইনাল পরীক্ষা আর তার প্রস্তুতি ওরা জোড় কদমে শুরু করে দিয়েছে।ইতিমধ্যে শহর তথা পুরো বিশ্বকে গ্রাস করছে এক অজানা অসুখ 'কোভিড-নাইনটিন', তাই বলা যায় ইদানিং হট কেক এর মতো সকলের মুখে মুখে এই একটা বিষয় নিয়েই আলোচনা ।
মোহর আর শ্রেয়া দুজনেই ক্লান্ত এই সবকিছুর মধ্যে, তখন ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি যেখানে তুঙ্গে, সেখানে এই কোভিড বিষয়টি যেন তাদের কাছে বিষফোড়ার মতো মনে হতে শুরু করলো । যাইহোক কোচিং ছুটির পর যখন বাড়ি ফেরার পালা ডানলপ থেকে বাসে উঠে প্রথমে দুজনেই শ্যামবাজারে নামবে, তারপর যে যার নির্দিষ্ট বাসে উঠে বাড়ি ফিরবে । প্রতিদিনের মতো সেদিনও, দুজনেই গল্প করতে করতে শ্যামবাজার অব্দি পৌঁছালো, তারপর যে যার বাস আসতে, একে-একে তাতে উঠে গেলো । তাঁদের দুজনের মধ্যে কেউই আসলে ভাবতে পারেনি যে ওটাই ছিলো ওদের কলেজ বন্ধ হওয়ার পরে শেষ দেখা । দিন যেতে যেতে পরিস্থিতির আরো অবনতি হলো, আক্রান্তের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়ে গেলো ।
আগামী সপ্তাহে পড়তে যাওয়ার দিন উপস্থিত, কিন্তু দুজনের মধ্যে কেউই নিজেদের পরিবারের আদেশ অমান্য করে পড়তে যেতে পারলো না । তবে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ হতো প্রতিদিনই, ফোনের মাধ্যমে । এইভাবে দেখা গেলো গোটা একটা মাস শেষ হয়ে গেলো, অন্যদিকে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা এতটাই বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করলো যে, প্রধানমন্ত্রী গোটা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে দিলেন ।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রভাব পড়লো শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা তথা দেশের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রের উপরে । ফাইনাল পরীক্ষার দিন পিছিয়ে যেতে শুরু করলো । কয়েক মাস ধরে দীর্ঘস্থায়ী এই পরিস্থিতিতে গোটা দেশটাকে যেন নাজেহাল করে তুলেছিলো । এদিকে, কয়েক মাস অতিবাহিত হতে না হতেই দেখা গেলো রাজ্যের পরিস্থিতি একেবারেই হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছে, হয়তো চেষ্টা করলেও আর সামাল দেওয়া সম্ভবপর নয় ।
শুধু শ্রেয়া কিংবা মোহরই নয়, তাঁদের মতো হাজার ছাত্র -ছাত্রী এই পরিস্থিতিতে রীতিমতো নাজেহাল হয়ে পড়েছিলো । দেশ, রাজ্য, শহর তথা গোটা বিশ্ব যেন এই মহামারির অভিশাপে জর্জরিত হয়ে গেলো । মানসিক অবসাদ যেন নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিলো । লকডাউনের সীমা বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করলো এবং তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব নিয়েই মানুষের জীবনের চাকা 'নিউ নর্মাল' নামে এগিয়ে চলতে লাগলো । এই 'নিউ নর্মাল' প্রাথমিক ভাবে প্রভাব ফেললো কমবেশি সকলের উপরই ।
এত কিছুর মধ্যেই শ্রেয়া আর মোহর অন্যান্যদের মতোই এই নিউ নর্মালের সঙ্গে নিজেদেরকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো । প্রথমদিন থেকেই ওদের বন্ধুত্বের মধ্যে এমন একটা বিষয় আছে, যা হয়তো খুব সহজে আজকাল চোখে পড়ে না, তা হলো ওদের একে অপরের উপর একটা অদ্ভুত বিশ্বাস । কলেজ জীবনের শুরু থেকেই ওদের এই মূলমন্ত্রটা যেন ওদের বন্ধুত্বটাকে আরো অনেক বেশি করে দৃঢ় করে তুলতে সাহায্য করেছে ।
তাই প্রতিদিনের ব্যস্ততা, ভালো, মন্দ মেশানো দিনগুলি যেমনভাবেই কাটুক না কেন, নিজেদের মধ্যে যখন ওরা কথা বলে সেই সময়টা যেন ওরা ওই কলেজের বেঞ্চেই ফিরে যায়, মনে হয় না যেন দূরত্ব তাঁদের বন্ধুত্বে কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছিলো । সময় তো থামতে জানে না, তাই অপেক্ষারা হয় ধ্রুবক । ভালো-মন্দ কিংবা মন্দ-ভালো চাকাটা যেভাবেই ঘুরুক না কেন সকলেই আশাবাদী যে অন্ধকার মুছে যাবে, আলোর স্পর্শে । ধীরে ধীরে পরিস্থিতির বিচারে শিক্ষামন্ত্রী তথা রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তে জানা গেলো যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চূড়ান্ত বর্ষের ফলপ্রকাশ হবে দুর্গাপুজোর আগেই । এই সংবাদ প্রকাশিত হলে গোটা ছাত্রসমাজ ভীষণই আনন্দিত হয়ে ওঠে ।
শ্রেয়া আর মোহরও ভীষণই আনন্দিত হয় । এরপর ওই বছরই পয়লা ডিসেম্বর বিজ্ঞানীদের অসীম প্রচেষ্টার ফলে আবিষ্কার হয় ভ্যাকসিন । ততদিনে গ্রাজুয়েশন এর রেজাল্ট ও বেরিয়ে গেছে । অবশেষে নিউ নর্মাল-এ পরিস্থিতি যখন একটু স্বাভাবিক, মোহর আর শ্রেয়ার আবার দেখা হলো । বিগত তিন বছরের মতোই ৫-ই জানুয়ারী, শ্রেয়ার জন্মদিনের ঠিক পরের দিন । সারাদিন তারা একসঙ্গে কাটালো, আর অন্যান্য বারের মতোই বিকেলে বাড়ি ফেরার আগে মোহর বললো, "জানি দেখা হবে !" শ্রেয়া আবারও হেসে বললো "নিশ্চয়ই !" এইভাবেই হয়তো 'নর্মাল 'থেকে 'নিউ নর্মালে' বন্ধুত্বের চাকাগুলো আরও এক ধাপ করে এগিয়ে যায়।
© মাম্পি মল্লিক
0 মন্তব্যসমূহ